close(x)
 

নানা কৌশলেও শিক্ষকদের ক্লাসে ফেরাতে পারছে না মাউশি

by Education বাংলাদেশ Published: July 28, 2023

আন্দোলন বন্ধ করে শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে নিতে অনুপস্থিতির তালিকাসহ নানা কৌশল নিচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি এখনই মানা সম্ভব নয় বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু মাউশির হুমকি ও শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের পরও আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন শিক্ষক নেতারা। এ নিয়ে শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষকরা এখন মুখোমুখি অবস্থান করছে।

ইতোমধ্যে ক্লাসে অনুপস্থিত ৩৪ জনকে শোকজও করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে যেসব প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত, তাদের নামের তালিকা চেয়েছে শিক্ষা বিভাগ। তবে প্রশাসনের এমন কঠোর অবস্থানের মাঝেও জাতীয়করণের দাবি আদায়ে রাস্তা ছাড়ছেন না দেশের বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকরা।

আন্দোলনরত শিক্ষকদের ভাষ্য, ক্লাসে ফেরত পাঠাতে কড়া নির্দেশনা দিয়ে লাভ নেই। তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কথা বলতে চান। তবে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত না পেলেও বাড়ি ভাড়া, উৎসব ভাতা বা অন্য সুবিধা বৃদ্ধির ঘোষণা পেলেও তারা ঘরে ফিরবেন। কারণ দীর্ঘসময় ধরে চলা আন্দোলন জমে ওঠার পর একেবারে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে চান না শিক্ষকরা। এদিকে শিক্ষকদের পূর্বঘোষিত স্কুলে তালা দেওয়ার কর্মসূচি চলমান থাকলেও অনেক জায়গায় তা পালন হচ্ছে না বলে জানা গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির পক্ষ থেকে ক্লাসে অনুপস্থিত শিক্ষকদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেওয়ার কারণে তালা দেওয়ার কর্মসূচি কিছুটা শিথিলও হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের ‘জিম্মি’ করে জাতীয়করণের দাবিতে যে আন্দোলন চলছে, তা গ্রহণযোগ্য নয় দাবি করে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘জাতীয়করণের বিষয়টি নিয়ে আমরা শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে বসেছি, আলোচনাও করেছি। এরপর অনেক শিক্ষক বাড়ি ফিরে গেছেন। অনেকে আন্দোলনে থেকে গেছেন। শিক্ষকদের জায়গা তো শ্রেণিকক্ষে। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে এ ধরনের আন্দোলন গ্রহণযোগ্য নয়।’

শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, জাতীয়করণের বিষয়টিও শিক্ষকদের কাছে স্পষ্ট নয়। কারণ যারা সরকারি কর্ম কমিশনের মাধ্যমে সরকারি স্কুল ও কলেজে নিয়োগ পান, আবার যারা বেসরকারি এমপিওভুক্ত তাদের এক জায়গায় নিয়ে আসতে গেলে কী পদ্ধতিতে আনা যাবে, আদৌ আনা যাবে কিনা নানা প্রশ্ন রয়েছে। এটি হঠাৎ আন্দোলন করে আদায়ের বিষয় নয়।

জাতীয়করণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দুটি কমিটি করা হয়েছে এবং তারা দ্রুত প্রতিবেদন দেবে। প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকার পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে। আমি আশা করব, সব শিক্ষক দ্রুত শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাবেন।

সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সুখবরের ইঙ্গিত না পেলেও আশা ছাড়ছেন না শিক্ষক নেতরাও। উল্টো সরকার আন্দোলন ঠেকাতে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে বলে অভিযোগ তাদের। সব মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা হওয়ার আগে ক্লাসে না ফেরার সিদ্ধান্তে তারা অনড় বলে জানিয়েছেন। আন্দোলনরত শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ কাওসার আহমেদ বলেন, ‘অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যা তাতে জাতীয়করণ করার বিষয়টি সময় সাপেক্ষ হবে, সেটা আমরাও মনে করি। কিন্তু লাখ লাখ শিক্ষকের কষ্টের কথা আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলতে চাই। আশা করি সেই সুযোগ পাব। নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী এ সংক্রান্ত কোনো চিন্তার কথা শিক্ষকদের উদ্দেশে ঘোষণা করবেন। সেই অপেক্ষায় আছি।’

গত ১১ জুলাই থেকে এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক শিক্ষকেরা তাদের প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ বা সরকারি করার দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। টানা অবস্থানের কারণে অনেকে অসুস্থও হয়ে পড়েছেন। শুরুতে মাউশির মহাপরিচালক শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করলেও কর্মসূচি থেকে সরেননি তারা। পরে ১৯ জুলাই শিক্ষামন্ত্রী তাদের সঙ্গে বসেন। পরে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, নির্বাচনের আগে শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া বিবেচনায় নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে এ বিষয়ে একটি গবেষণা কমিটি করার কথা জানিয়ে মন্ত্রী তাদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তা কানে তোলেননি শিক্ষকরা। গত ২২ জুলাই রাতে আন্দোলনরত শিক্ষকরা বৈঠক করেছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের সঙ্গে। বৈঠকে তিনি শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দলকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষক নেতারা।

আন্দোলনে থাকা বিটিএ’র ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার সভাপতি হারুন অর রশীদ বলেন, ‘শিক্ষকদের স্কুলে ফেরানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে । শিক্ষামন্ত্রী আমাদের কোনো মূল্যায়ন করেননি। এখন স্কুলে টিম পাঠিয়ে তালিকা তৈরি করে যারা অনুপস্থিত তাদের শোকজ করা হচ্ছে। আমরা তাদের প্রজ্ঞাপন নিয়ে চিন্তা করি না। মন্ত্রীর কাছ থেকে কিছু আশাও করি না।’ তাহলে কিসের আশায় শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সময় দিলে আমরা দেখা করে একটু কথা বলতে চাই। যদি তার মনে আমাদের জন্য কিছু করার চিন্তা থাকে সেটা শুনে যেতে চাই।’

শিক্ষক নেতারা বলছেন, সরকারি শিক্ষকরা তাদের মূল বেতনের ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া পান। আর এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা পান মাত্র ১ হাজার টাকা। এটা যৌক্তিক হারে বৃদ্ধি করা দরকার। সরকারি শিক্ষকরা উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের শতভাগ। আর এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা পান মাত্র ২০ ভাগ। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে টিকে থাকতে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিকল্প নেই- এমনটাই ভাষ্য শিক্ষকদের।

হঠাৎ বাতিল গ্রীষ্মের ছুটি

শিক্ষামন্ত্রীর আহ্বানের পরও শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরে না যাওয়ায় হঠাৎ করেই গ্রীষ্মের ছুটি বাতিল করেছে মন্ত্রণালয়। গত ২০ জুলাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি (১৪ দিন) শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষকদের বৈঠকের পর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণার পর ১৯ জুলাই হঠাৎ করেই এই ছুটি বাতিল করা হয়। এতে অনেক শিক্ষক, অভিভাবক বিপাকেও পড়েছেন বলে দাবি করেছেন। শিক্ষক নেতাদের দাবি, আন্দোলন থামাতে এটা করা হয়েছে। তবে শিক্ষা প্রশাসনের ভাষ্য, এই ছুটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত আগেই ছিল। জানাতে বিলম্ব হয়েছে।

বাড়তে পারে শোকজ পাওয়া শিক্ষকদের সংখ্যা

কোনো অবস্থাতেই শিক্ষকদের বাগে আনতে না পেরে ক্রমেই হার্ডলাইনে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি। ২৩ জুলাই মাউশির মনিটরিং অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশন উইংয়ের বরাত দিয়ে মাউশির সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক-২) এস এম জিয়াউল হক হেনরী শোকজের চিঠি দেন অনুমোদন ছাড়াই স্কুলে অনুপস্থিত থাকা ৩৪ জন শিক্ষককে। এতে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেমের আওতায় গত জুন মাসেই মাধ্যমিকের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে ৩৪ জন শিক্ষককে বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়নি। আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে উপস্থিত না থাকার সুস্পষ্ট কারণ মাউশিতে পাঠাতে হবে।

বিশেষ শোকজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শীর্ষে আছে রংপুর অঞ্চল। এই অঞ্চলের ১০ জন শিক্ষক অনুপস্থিত ছিলেন। শোকজের বিষয়ে জিয়াউল হক বলেন, যাদের শোকজ করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই দুই দিন বা তার বেশি সময় ধরে স্কুলে আসেন না। এটা সতর্কীকরণ নোটিশ। ভবিষ্যতে কেউ এমন করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে কয়েক দফা শোকজ করা হয়েছে।

মন্ত্রণালয় ও মাউশি সূত্রে জানা গেছে, অনুপস্থিতির তালিকা করার কাজ চলমান থাকবে। ফলে শোকজের সংখ্যাও বাড়বে। কারণ এখনো অনেক স্কুলের শিক্ষক ছুটি না নিয়েই ঢাকায় আছেন। অন্যদিকে শোকজের পর এবার প্রতিদিন অনুপস্থিত শিক্ষকদের তালিকা পাঠাতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২৩ জুলাই মাউশির পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক এ এস এম আব্দুল খালেক এই চিঠি জারি করেছেন। এ বিষয়ে আবদুল খালেক বলেন, মাউশির পক্ষ থেকে এক চিঠির মাধ্যমে এই তালিকা চাওয়া হয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। মাঝেমধ্যেই এমন তালিকা চাওয়া হয়ে থাকে।