close(x)
 

যে কারণে জাতীয়করণ চান শিক্ষকরা, আন্দোলনের সর্বশেষ পরিস্থিতি

by Education বাংলাদেশ Published: July 27, 2023

শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সরকারি ও বেসরকারি বৈষম্য দূরিকরণ এবং ধনি-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ১১ জুলাই, ২০২৩ থেকে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র নেতৃত্বে চলমান লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির ১৭ তম দিনের কর্মসূচী চলছ্বে।

আন্দোলনরত শিক্ষকরা জানান, এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ মাত্র ২৫% উৎসব ভাতা, ১,০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া এবং ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। অথচ একই কারিকুলামের অধীন একই সিলেবাস, একই একাডেমিক সময়সূচি, একইভাবে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়নের কাজে নিয়োজিত থেকেও আর্থিক সুবিধার ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছে পাহাড়সম বৈষম্য। তাছাড়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বেতন স্কেল সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বেতন স্কেলের একধাপ নিচে প্রদান করা হয় এবং সহকারি প্রধান শিক্ষকদের উচ্চতর স্কেল প্রদান না করার ফলে উচ্চতর স্কেলপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষকদের বেতন স্কেল ও সহকারি প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল সমান হওয়ায় প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সহকারি প্রধানদের মধ্যে দীর্ঘদিনের অসন্তোষ রয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে বছরের পর বছর উপজেলা থেকে শুরু করে জেলা ও বিভাগীয় শহরে সমাবেশ, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, প্রতীকি অনশন, অবস্থান ধর্মঘট, কর্মবিরতিসহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর নিকট বারবার স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে।

তাঁরা জানান, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসরে যাবার পর অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। ফলে অনেক শিক্ষক/কর্মচারী টাকা পাওয়ার পূর্বেই অর্থাভাবে বিনা চিকৎসায় মৃত্যুবরণ করছেন। তাছাড়া কয়েক বছর যাবৎ কোন প্রকার সুবিধা না দিয়েই অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্ট খাতে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে অতিরিক্ত ৪% কর্তন করা হচ্ছে যা অত্যন্ত অমানবিক। তাই অতিরিক্ত ৪% কর্তনের প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলসহ অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্ট অফিস ঘেরাও করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু অদ্যাবধি কোন প্রতিকার পাননি।

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ বজলুর রহমান মিয়া জানান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে একটি যুদ্ধবিধস্ত দেশে প্রায় ৩৭ হাজার প্রাথমকি বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে বঙ্গবন্ধু তনায়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ২৬ হাজার বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে জাতির কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন। এমতাবস্থায় দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে দ্রুত জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়ন, শিক্ষায় বিনিয়োগে ইউনেস্কো-আইএলও’র সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন এবং সবার জন্য শিক্ষা গ্রহণের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষক-কর্মচারীগণ লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। স্বপ্নের পদ্মা সেতু তৈরি, বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ, রূপপুর পারমানবিক বিদুৎকেন্দ্র ও মাতার বাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে কোটি কোটি বই বিতরণ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন, মেট্রোরেল নির্মাণ, কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেভাবে উন্নয়ন হয়েছে, শিক্ষা ও শিক্ষকদের উন্নয়ন সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। বর্তমান সরকার ইতোমধ্যেই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দেয়ায় বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বিটিএ)র পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। বক্তাগণ আরো বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতেই হবে। শিক্ষাব্যবস্থা স্মার্ট করতে হলে দরকার স্মার্ট শিক্ষক। প্রতিবছর শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ দারিদ্রতার কারণে মেধাবী হওয়া স্বত্বেও ঝড়েপরছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবার ও দেশ। তাই স্মার্ট শিক্ষক পেতে এবং দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থী রোধকল্পে শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের কোন বিকল্প নেই।

তিনি আরও জানান, জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)’র অনুমোদি ১৪৬টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত শিক্ষকদের মর্যাদা বিষয়ক সনদের সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ অথবা জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের নির্দেশনা থাকলেও ২০২২-২৩ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১১.৯২ শতাংশ অথবা জিডিপি’র ১.৮৩ শতাংশ। অথচ ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বরাদ্দ কমিয়ে জাতীয় বাজেটের ১১.৫৭ শতাংশ অথবা জিডিপির ১.৭৬ শতাংশ করা হয়েছে। তাই ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকসহ সারাজাতি আজ চরমভাবে ক্ষুব্ধ ।

বিটিএ সভাপতি বলেন, গত ০৮ মার্চ ২০২৩ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৩ মার্চ, ২০২৩ সারাদেশের জেলা সদরে এবং কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শিক্ষক-কর্মচারীদের মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল এবং জেলা প্রশাসক/বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। ১৪ মার্চ, ২০২৩ বেসরকারি সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২ ঘণ্টার কর্মবিরতি পালনসহ ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় এবং জাতীকরণের যৌক্তিকতা তুলে ধরে লিফলেট বিতরণ করা হয়। গত ২০ মার্চ, ২০২৩ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের মহাসমাবেশে ২০২৩-2024 অর্থ বছরের জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখার এবং মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের ঘোষণা দেয়ার আহবান জানান। ব্যর্থতায় ১১ জুলাই 202৩ থেকে ঢাকয় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাই বাজেটে জাতীয়করণের ঘোষণা কিংবা দিক নির্দেশনা না থাকায় এবং বিগত অর্থ বছরের চেয়েও কম বরাদ্দ রাখায় ১১ জুলাই ২০২৩ থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে পূর্বঘোষিত লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি চলছে। গত ৭ জুলাই মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নেহাল আহমেদ বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বিটিএ)’র প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করে মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রীর সাথে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে বৈঠকের আয়োজন করা হলেও তা উপেক্ষা করা হয়েছে। এমনকি সদ্য গজিয়ে ওঠা সরকারের তোষমদকারী সংগঠনের উপজেলা থেকে শুরু করে মহানগর নেতারাও উপস্থিত থেকে বেঠকের শৃঙ্খলা বিনষ্ট করেছে।শিক্ষক-কর্মচারীগণ চান মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা। তাই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা না পাওয়ায় শিক্ষক- কর্মচারীগণ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। গতকাল বাংলাদেশ শিক্ষক সমিটি (বিটিএ)’র সাথে সমমনা সংঠনগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে বিটিএর সভাপতি অধ্যক্ষ মোঃ বজলুর রহমান মিয়াকে আহবায়ক, সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শেখ কাওছার আহমেদ কে প্রধান সমন্বয়কারী এবং ঐক্যবদ্ধ অন্যান্য সকল সংগঠনের সভাপতিগণ যুগগ্ম আহবায়ক ও সাধারণ সম্পাদকগণকে সমন্বয়কারী করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়েছে।

শিক্ষক নেতারা জানান, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে চলমান লাগাতার অবস্থান কসূচিতে অংশগ্রহণের ফলে ঢাকা এখন শিক্ষকের নগরীতে পরিণত হয়েছে। কর্মসূচির ১ম ও ৭ম দিন পুলিশের অতিবাড়াবাড়ি এবং লাঠিচার্জের ফলে সংগঠনের সভাপতি অধ্যক্ষ মোঃ বজলুর রহমান মিয়াসহ শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী আহত হয়েছেন। যার মধ্যে ১ জন মৃত্যুবরণ করেছেন ৩ জনের অবস্থা গুরুতর এবং অনেকেই হাসপাতলে চিকিৎসাধীন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণ শিক্ষকদের সদিচ্ছা থাকা স্বত্বেও ব্যক্তি স্বার্থে কতিপয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি/গভর্ণিং বডিসহ প্রতিষ্ঠান প্রধানদের জাতীয়করণের বাহিরে থাকতে চাওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীগণ লাগাতার অবস্থান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন।

২২ জুলাই বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা কবির বিন আনোয়ার এর সাথে সাক্ষাৎ করে শিক্ষক-কর্মচারীদের মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের ন্যায়সঙ্গত দাবি তুলে ধরেন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের জন্য অনুরোধে জানান। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার আশ্বাস প্রদান করেন। সেসময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর শিক্ষা বিষক সম্পাদক শামসুন্নাহার চাঁপা সহ প্রমূখ নেতৃবৃন্দ।

৭ জুলাই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নেহাল আহমেদ এবং বিটিএ’র সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ৫ সদস্যের প্রতিনিধিগণ বৈঠক করেন। মহাপরিচাল বিটিএ’র নেতৃবৃন্দের সাথে শিক্ষামন্ত্রীর বৈঠকের আয়োজন করেন। শিক্ষা মন্ত্রীর বৈঠকে কিছু সংগঠনকে বাদ দিয়ে আন্দোলনরত বিটিএ’র পাশাপাশি মূল ধারার শিক্ষক সংগঠনসহ একটি সংগঠনের অঙ্গসংগঠনের অখ্যাত, স্বঘোষিত ও সদ্য গজিয়ে ওঠা থানা/মহানগর পর্যায়ের শিক্ষক নেতাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। যার ফলে বৈঠকের পরিবেশ ধরে রাখতে পারেননি শিক্ষা মন্ত্রী। বৈঠকে শিক্ষা মন্ত্রীর বক্তব্য ও গ্রীষ্মের ছুটি বাতিলের সিদ্ধান্তে সরাদেশের বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীগণ মর্মাহত হন। গ্রীষ্মের ছুটি শীতকালে প্রদানের ঘোষণায় সারাদেশে ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে সমালোচনার ঝড় ওঠে। শিক্ষক-কর্মচারীগণ শিক্ষা মন্ত্রীর বক্তব্যসহ গ্রীষ্মের ছুটি বাতিলের নির্দেশ প্রত্যাখান করে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রাখার এবং মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা চান। তাই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ছাড়া শিক্ষক-কর্মচারীগণ শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাবেন না। পুলিশের লাঠিচার্জ ও প্রচন্ড তাপদহে শিক্ষক-কর্মচারীদের অসুস্থতা, জাতীয় প্রেস ক্লাব সংলগ্ন হাই কোর্টে প্রধানমন্ত্রীর আগমণ এবং রাজনৈতিক দলসমূহের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি থাকার করণে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির আশঙ্কায় গোয়েন্দা বিভাগ ও পুলিশ প্রশাসনের অনুরোধসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ২৭ জুলাই বৃহস্পতিবার পূর্ণদিবস ও ২৮ জুলাই শুক্রবার ২টা পর্যন্ত সীমিত পরিসরে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেন শিক্ষক-কর্মচারী নেতৃবৃন্দ।